আপনার সন্তান কি ফোনে আসক্ত?- এর থেকে মুক্তির উপায় জেনে নিন
আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে ফোনের ব্যবহার যেমন সবকিছু আমাদের মুঠোয় এনে দিচ্ছে। ঠিক তেমনি, ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের ক্ষতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য ফোনের ব্যবহার মারাত্মক ক্ষতিকর একটা দিক। আপনার সন্তান ফোনে আসক্ত কিনা তা কিভাবে বুঝবেন এবং আসক্তি থেকে প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে আমি আপনাদের জানাবো আমার আজকের এই আর্টিকেলের মাধ্যমে। বিস্তারিত জানতে শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকুন।
এখন আমরা শুরু থেকেই শিশুদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছি। কিন্তু আপনি কি জানেন? আপনি আপনার সন্তানের হাতে কি মারাত্মক প্রযুক্তি তুলে দিচ্ছেন, যা আপনার সন্তানের জন্য কতটা ক্ষতিকর। এই আধুনিক প্রযুক্তি কিভাবে আপনার সন্তানকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে তা আপনি নিজেও জানেন না। আপনার সন্তানের মধ্যে কিছু লক্ষণ দেখলে আপনি সহজেই বুঝতে পারবেন আপনার সন্তান ফোনে আসক্ত। আপনার সন্তান ফোনের প্রতি আসক্ত কিনা তা আপনি বুঝতে যদি না পারেন, তাহলে আজকের এই আর্টিকেলটি আপনার জন্য।
আজকের এই পোস্ট এর মাধ্যমে আপনার শিশুর ফোনের প্রতি আসক্তির লক্ষণ, ফোন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক এবং ফোনের প্রতি আসক্তি থেকে মুক্তির উপায় সম্পর্কে জানতে পারবেন।
সূচিপত্র: শিশুদের ফোনের প্রতি আসক্তি এবং এর থেকে মুক্তির উপায়
- ফোনে আসক্তির লক্ষণ
- শিশুদের ফোন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক
- শিশুদের ফোন আসক্তি কমানোর উপায়
- শেষ কথা
ফোনে আসক্তির লক্ষণঃ
নিচের লক্ষণগুলো যদি আপনার সন্তানের মধ্যে দেখা যায়, তাহলে আপনি বুঝবেন আপনার সন্তান ফোনে আসক্ত। আসুন আমরা লক্ষণ গুলো দেখে নিই।
ফোনের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া: আপনি ডাকছেন, তাতে কোন সাড়া দেয় না বা আশেপাশে কি ঘটছে তাতে তার কোন খেয়াল নেই, তাহলে সে শিশুকে আমরা বলব ফোন-আসক্ত। বাচ্চা যদি ফোন দেখতে গিয়ে একদম ফোনের মধ্যে হারিয়ে যায় অর্থাৎ ফোন দেখার সময় বাইরের কোন কথা যদি তার কানে না যায়, তাহলে ভাববেন আপনার সন্তান ফোনের প্রতি নেশাসক্ত।
খাওয়া ও ঘুম ভুলে যাওয়া: অনেক সময় দেখা যায় ফোন হাতে থাকলে বাচ্চারা খাওয়া-ঘুম ভুলে যাই। খেতে চাই না বা ঘুমাতে চাই না, তাহলে বুঝবেন আপনার সন্তান ফোন আসক্ত।
বন্ধু বা অন্যদের সাথে না মেশা: অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুরা মনে করে ফোনে ব্যবহৃত চ্যাটিং, গেমিং, ফেসবুকিং এগুলোই তাদের চিত্তবিনোদনের মাধ্যম। তাই সে ফোন ছাড়া বাইরের কারো সাথে মিশতে চায় না। আপনার সন্তান যদি বন্ধু বান্ধব বা বাইরের কারো সাথে মেলামেশা না করে তাহলে আপনি বুঝবেন আপনার সন্তান ফোনে আসক্ত।
কম কথা বলা: বাচ্চারা অতিরিক্ত ফোন আসক্ত হলে তাদের মানসিক সমস্যার কারণে তারা কথা কম বলে। তাই আপনি যদি দেখেন আপনার সন্তান কম কথা বলছে সে ক্ষেত্রে আপনি বুঝে নিবেন আপনার সন্তান ফোন আসক্ত।
অতিরিক্ত জেদ ও খিঁটখিটে স্বভাব: ফোনের অতিরিক্ত ব্যবহার শিশুদের মেজাজ খিটখিটে করে ফেলে। এখনকার অধিকাংশ শিশু প্রচুর জেদ করে এবং খিটখিটে স্বভাবের হয়ে থাকে। যার মূল কারণ হলো ফোনের ব্যবহার। ফোন আসক্ত শিশুদের একটি অন্যতম লক্ষণ হল অতিরিক্ত জেদ ও খিটখিটে স্বভাব।
শিশুদের ফোন ব্যবহারের ক্ষতিকর দিকঃ
মাত্রাতিরিক্ত ফোনের ব্যবহার শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা দেয়। এজন্য এখনকার শিশুদের মধ্যে অতিরিক্ত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
মানসিক সমস্যা: ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুদের বিভিন্ন মানসিক সমস্যা দেখা যায়। ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুরা বুদ্ধির নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে। তাই দেখা যায়, অনেক শিশু বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হয়ে থাকে। একটি সুস্থ বাচ্চা অতিরিক্ত ফোন ব্যবহারের ফলে দেখা যায় তারা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং কথা বলতে পারেনা। এছাড়াও ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের অতিরিক্ত উত্তেজনা, বিরক্তি, নিজের প্রতি অবিশ্বাস ইত্যাদি মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
শারীরিক স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রভাব: ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুর মাথার সমস্যা, চোখের সমস্যা, শিরা সংক্রান্ত সমস্যা, কানে শোনার সমস্যা সহ বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়াও শিশুদের ক্যান্সার, টিউমার, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত জটিল রোগগুলো ফোনের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে।
সামাজিক সম্পর্কের অবনতি: অধিক সময় জুড়ে ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুরা সামাজিক সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। ফোন ব্যবহারের ফলে শিশুরা আশেপাশের আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধবের সাথে মিশতে চায়না। ফলে শিশুরা সহপাঠী এমনকি বাবা-মা থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
নিরাপত্তা সমস্যা: শিশুরা ফোন ব্যবহারের মাধ্যমে অপরাধের শিকার হতে পারে। অশ্লীল বা অপব্যবহারের মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি শিশুরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে।
শিশুদের ফোন আসক্তি কমানোর উপায়ঃ
শিশুদের সামনে ফোন ব্যবহার কম করা: আমরা সবাই জানি, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। বড়দের যা কিছু করতে দেখবে তারা সেটাই শিখবে। তাই আমাদেরকে ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে সংযমী হতে হবে। এখন আমরা হাতের মুঠোয় ছোট্ট ফোনটাতে আমাদের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকি। তবুও আসুন চেষ্টা করি শিশুদের সামনে ফোনের ব্যবহার না করতে। শুধুমাত্র প্রয়োজনে আমরা ফোনের ব্যবহার করব এবং শিশুদের বুঝাবো ফোন শুধুমাত্র প্রয়োজনেই ব্যবহৃত হয়।
মোবাইল ফোন খেলনা হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা: ব্যস্ত সময়ের ব্যস্ত বাবা মায়েরা আজকাল সন্তানের হাতে খেলনা হিসেবে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছে। অনেক বাবা মা আছে, যারা বাচ্চার বায়না সামলাতে বা কান্না থামাতে বাচ্চার হাতে মোবাইল ফোন ধরিয়ে দেয়। মোবাইলে গেম, গান,কার্টুন, ভিডিও ইত্যাদি চালিয়ে বাচ্চার হাতে ফোন ধরিয়ে দিলে বাচ্চা অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ফলে, তারা বায়না বা কান্না থামিয়ে দেয়। এর ফলে আমরা বাচ্চাদের সামলাতে নিজেই বাচ্চাদের ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি। তাই আসুন, খেলনা হিসাবে বাচ্চাদের হাতে ফোন তুলে না দিয়ে তাদেরকে অন্যভাবে সামলাতে চেষ্টা করি।
শিশুকে অন্য কাজে ব্যস্ত রাখা: ছোট থেকেই শিশুকে নানা রকম সৃজনশীল কাজে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করি। যেমন ছবি আঁকা, খেলাধুলা করা, গান গাওয়া, গাছের পরিচর্যা করা ইত্যাদিতে বাচ্চাদের আগ্রহ সৃষ্টি করি। এতে তারা যেমন ফোনের প্রতি আকৃষ্ট হবে না, তেমনি শিশুদের মূল্যবোধ ও চিন্তাশক্তি বিকশিত হবে। এছাড়াও শিশুদের গল্পের বই পড়ার অভ্যাস তৈরি করুন। প্রয়োজনে নিজেরা শিশুদের সামনে বসে গল্পের বই পড়ুন।
শিশুকে বেশি বেশি সময় দেওয়া: আপনার সন্তানদের সাথে আপনি বেশি বেশি সময় কাটান। কারণ একাকী অবস্থায় শিশুরা বেশি ফোনের প্রতি আসক্তি দেখায়। তাই শিশুদের সময় দিন। প্রয়োজনে তাদের নিয়ে বাইরে ঘুরতে যান। এতে করে তারা ফোনের আসক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হবে।
ফোন দেখার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া: আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর যুগে শিশুদের পড়াশোনা ও অন্যান্য শিক্ষনীয় দিকগুলো তুলে ধরার জন্য তাদের হাতে ফোন দেওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সেক্ষেত্রে আমাদের সময় বেঁধে দিতে হবে। যাতে তারা মোবাইলের প্রতি আকৃষ্ট হতে না পারে। তাই আমরা দিনের যে কোন সময় তাদের অল্প কিছুক্ষণের জন্য ফোন দিব।
বাড়িতে নেটওয়ার্ক সংযোগ বন্ধ রাখা: নেটওয়ার্কিং সংযোগের কারণে শিশুরা ফোনে যখন যা চাচ্ছে, তখন সেটাই পেয়ে যাচ্ছে। তাই বাড়িতে যদি ফোনের নেটওয়ার্ক থাকে তাহলে নেটওয়ার্ক সংযোগ বন্ধ রাখতে হবে। সে ক্ষেত্রে শিশুরা ফোনে তেমন আগ্রহ পাবে না।
স্মার্টফোন ব্যবহার না করা: আধুনিক যুগে স্মার্টফোন এর ব্যবহার বেড়েই চলেছে। এটির প্রতি শিশুরা বেশি আগ্রহী। তাই যদি বাবা মায়েরা শিশুদের সামনে স্মার্টফোন ব্যবহার না করে বাটন ফোন ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে শিশুদের ফোন আসক্তি অনেকাংশে দূর করা সম্ভব।
শেষ কথাঃ
আশা করি, আজকের এই লেখনী থেকে আপনারা শিশুদের ফোন ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব ও তার প্রতিকার সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তাই আসুন, আজ থেকেই আমরা শিশুদের ফোন ব্যবহারের প্রতি সতর্ক হই। যাতে শিশুরা ফোনের প্রতি আসক্ত হতে না পারে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url